গল্পটি শুরু এক বেকার যুবক নিয়ে। যুবকটির জন্ম বাংলাদেশের কোন এক গ্রামে। হাত-পা ঝাড়া বেকার। বহুদিন ধরে বহু পথে যুবক চাকরী খুঁজেছে বহু পরিক্রমায়। পথে পথে তিনি ঘুরেন আর সাধনা করে একটা সরকারী চাকুরী পাওয়া যায় কোন পথে হয়। সাধনা ঔষধালয়েও বার কয়েক যুবক পদচারনা করেছে, প্রাচীন প্রতিষ্ঠান মোজাহের আর হামর্দদ-এ যাওয়ারও একটা পরিকল্পনা আছে। বলবর্ধক ভাল শালশার বোতল প্রয়োজন। ধন নাই, মান নাই শরীরটাই সহায়। শরীর ঠিক রাখতে যুবক ক্লান্তিহীন আর্য়ুবেদী পথে হাঁটছেন। শালশা কিনতে এসে দেখা হয় লতায় -পাতায় আত্মীয় এমন এক আত্মীয় কর্তার সাথে। কর্তা-আত্মীয় বয়সের স্কেল ষাটের ঘাটে তরী ফিরাবে ফিরাবে করলেও শরীরে ধরে রেখেছে রং করা চুলের মতো যৌবনের ঝিলিক। বৃদ্ধ বয়সেও যৌবনের ঝিলিক দেখে বুঝা যায় তিনি কতটা সম্পদশালী। সম্পদের সাথে শালী, মানে বউয়ের বোন। যুবক হেসে ফেলে আপন মনে। যদি চাকুরটা হয় কোন একদিন! তাহলে তারও বউ হবে একটা। বড়ই আনন্দ! আনন্দম হে মানব সন্তান! যুবক তৃষিত নয়নে সারি সারি দালানের সজ্জিত জানালা মকামে চোখ তুলে নয়নচাষ শুরু করে। আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে! প্যান্টের ব্যাক পকেটে হাত চালিয়ে মানিব্যাগ বের করে আনে যুবক, এটিই তার একমাত্র অবশিষ্ট বিলাসিতা। লতা-পাতার আত্মীয়ের দেয়া কার্ডখানি সযতেœ ব্যাগে রাখে। বেকার জীবন যৌবনের সব জৌলুস পুড়ে ফেলেছে অর্থাভাবের অনলে। ভাগ্যিস প্যান্টের ব্যাক পকেটে মানিব্যাগ রাখার বিলাসিতাটা এখনো পুড়ে যায়নি। সব পথ যখন হারিয়ে গেছে তখনই কর্তার দেয়া কার্ড নতুন রাস্তা খুলে দিল যুবকের জীবনে। চাকুরী খোঁজার এটাই একমাত্র অবশিষ্ট পথ। যুবক আবার ভবিষ্যতের দিকে চোখ বাড়ায়; সংসার , বউ, বাচ্চাকাচ্চা! আহা! চোখে জল! এতো জল...
দ’ুয়েক দিন গেল। যুবক পা বাড়ায় কর্তার বাসায়। কর্তা এক বন্দরের হর্তা। চাকুরী আসবে আসবে করে, কিন্তু আর আসে না। বছর গড়িয়ে যায়, কর্ণফুলীর অনেক জলও গড়িয়ে যায়, এই ফাঁকে বেকার যুবক আবাসন পাল্টায় কয়েকবার। চাকুরী হয় না আর হয় না কিন্তু যুবকের স্বপ্ন থেমে থাকে না। যুবক পালা করে বছরের পর বছর ঘুরতে থাকে কর্তাও বসায় একটা চাকুরীর আশায়, তাও আবার সরকারী চাকুরী। হঠাৎ একদিন কর্তার এক প্রস্তাব আসে, যথারীতি যুবকও হাজির। এক অদ্ভুত চাকুরীর প্রস্তাবনা। সরকারী চাকুরী, কিন্তু কোন মাইনে নাই। দীর্ঘদিন পায়ের চপ্পল ক্ষয়করা মর্মাহত যুবক নিজেকে সামলে নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠে চাকুরীটা সে করবে। চাকুরী বিশেষ কিছু নয়, নদীর মোহনায় সাগর তীরে দাঁড়িয়ে প্রতিদিন ঢেউ গুনে যাওয়া। যুবক সাগ্রহে রাজী হলেন। প্রথম কর্মদিবসে তিনি একখানা চেয়ার আর একখানা টেবিল নিজ খরচে কিনে নিলেন। দ্বিতীয় কর্মদিবসে তিনি একখানা বাঁশী, তৃতীয় কর্মদিবসে তিনি একখানা লাল পতাকা আর লম্বা একটা বাঁশ নিজ খরচে খরিদ করলেন। চতুর্থ কর্মদিবসে তিনি ঘরের গরু বিক্রি করে এ জোড়া উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন মাইকও কিনে ফেললেন। পঞ্চম কর্মদিবস শেষে আলোচ্য যুবক প্রচুর মাজার জেয়ারত আর ধর্ম-কর্ম করলেন। নতুন সপ্তাহে প্রথম কর্মদিবসে যুবক তার উন্নত মানের কর্ম-পদ্ধতি বাস্তবায়নে নামলেন। তিনি তার টিবিলের সামনে লম্বা বাঁশ দিয়ে লাল পতাকা তুলে দেয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশেরও একখানা পতাকা তুলে। সাগর হয়ে বন্দরগামী যত জাহাজই আসুক যুবক মাইক দিয়ে হাঁক দেন। ইংরেজীতে তিনি বলছেন, প্রিয় ক্যাপ্টেন, শুভেচ্ছা নিবেন। আমি বিশেষ রাষ্ট্রিয় কাজে নিয়োজিত সরকারী কর্মকর্তা। রাষ্ট্রিয় প্রয়োজনে আমি সাগর নদীর সঙ্গমে ঢেউ গণনার জরুরী কাজে নিয়োজিত। আপনারা যেখানে আছেন ঠিক সেখানেই অপেক্ষা করুন, দয়া করে অনুমতি বিহীন ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করবেন না, কারণ এতে করে রাষ্ট্রিয় জরুরী কাজ; ঢেউ গণনার কাজে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। আপনাকে ধন্যবাদ! এভাবে প্রতিদিন শত শত জাহাজ দাঁড়িয়ে থাকে অনুমতির অপেক্ষায়। লম্বা লাইনে অপেক্ষারত ক্যাপ্টেনগণ স্বশরীরে প্রতিনিধি পাঠাতে শুরু করলেন সদাশয় যুবক এর কাছে, যাতে তিনি ঢেউ গণনা কিঞ্চিত বন্ধ করে জাহাজ ভেতরে যাওয়ার অনুমতি প্রদানে সম্মত হয়। সযুবক পথের সন্ধান পেয়ে যায়। অতপর আপন জীবনে তিনি অঢেল সুখ আর সমৃদ্ধির পথে হাঁটতে শুরু করলেন। যুবকের আর কোনদিন মাইনে নেয়ার প্রয়োজন পড়ে নাই।